ডিজিটাল জগতের গোপন রহস্য: কম্পিউটার কেন শুধু শূন্য আর এক বোঝে?
ছোট্ট আনিশা ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল মুগ্ধ হয়ে। একটা ম্যাজিক গেমে রঙ-বেরঙের চরিত্রগুলো নাড়াচাড়া করছে, এবং কিছুক্ষন পরপর আনিশা বোতামে প্রেস করছে কি যেন লেখা হচ্ছে? তখন আনিশা জিজ্ঞাস করে, “মা, কম্পিউটার বোঝে কীভাবে আমি কী কাজ করছি?”
![ডিজিটাল বিশ্বের ভিত্তি: জিরো ও ওয়ান; কি রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাইনারি কোডে? 20 বাইনারি কোড কি এবং কিভাবে কাজ করে?](https://techpoth.com/wp-content/uploads/2024/02/image-6.png)
মায়ার এই সহজ প্রশ্ন এক গভীর সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে: কম্পিউটার আমাদের চেনা দুনিয়া থেকে আলাদা এক জগতে কাজ করে। জগতে যেখানে সবটা দাঁড়িয়ে আছে শুধু শূন্য আর একের উপর।
বাইনারি কোড কি এবং কিভাবে কাজ করে?
মূলত, কম্পিউটার হল অজস্র ছোট-ছোট সুইচের এক জটিল সমন্বয়! এসব সুইচ হয় চালু থাকতে পারে (যাকে বোঝায় ১) অথবা বন্ধ (যাকে বোঝায় ০)। শূন্য আর একের এই সাধারণ ব্যবস্থাটিকেই বলা হয় বাইনারি কোড বা বাইনারি ভাষা।
![ডিজিটাল বিশ্বের ভিত্তি: জিরো ও ওয়ান; কি রহস্য লুকিয়ে আছে এই বাইনারি কোডে? 21 বাইনারি জিরো এবং ওয়ান](https://techpoth.com/wp-content/uploads/2024/02/image-7.png)
কিন্তু বাইনারি কেন? ভাবুন একবার, বৈদ্যুতিক বাল্ব দিয়ে আপনি যদি নাম্বার লেখার চেষ্টা করেন? একটা বাল্ব জ্বলছে মানে ‘এক‘, আর নিভে আছে মানে ‘শূন্য‘। এখন যোগ করুন আরেকটা বাল্ব। এখন আপনি ০, ১, ২, ৩ চারটি নাম্বার দেখাতে পারবেন – দুটো বাল্ব আপনাকে চারটে অপশন দিচ্ছে। আর তিনটে বাল্ব? সেটা পারে আট রকম কম্বিনেশন বানাতে। কম্পিউটার এরকম লক্ষ লক্ষ বৈদ্যুতিক সুইচ ব্যবহার করে যার ফলে তা বিশাল পরিমাণ তথ্য জমা রাখতে পারে।
বাইনারি থেকে আমাদের চেনা জগতের সবকিছুতে রূপান্তর!
ম্যাজিকটা সম্পর্কে আরো জানা যাক, চলুন দেখি:
- নাম্বার: আমরা সাধারণত যেই দশভিত্তিক (ডেসিমেল) নাম্বারগুলো ব্যবহার করি সেখানে একটা ডিজিটের পজিশন অনুযায়ী তার আলাদা মূল্য থাকে (একক, দশক, শতক ইত্যাদি)। বাইনারি একই নিয়মে কাজ করে, শুধু দশের ঘরের বদলে এখানে ব্যবহার হচ্ছে দুইয়ের ঘরগুলো।
- অক্ষর ও চিহ্ন: ASCII এর মতো কিছু নিয়ম ব্যবহার করে কীবোর্ডে থাকা প্রতিটি অক্ষর, নাম্বার, এবং চিহ্নের জন্য একটা করে আলাদা বাইনারি কোড থাকে।
- ছবি: কম্পিউটার পর্দায় আমরা যেসব ছবি দেখি, সেগুলো আসলে অসংখ্য ছোট ছোট ডট বা পিক্সেল মিলে তৈরি হয়। পিস্কেলগুোর প্রতিটির রঙের জন্যও আলাদা বাইনারি কোড থাকে। এভাভাবে অসংখ্য পিক্সেল পাশাপাশি যখন দেখানো হয়, তখন মনে হয় ছবিটা অনবরত পরিবর্তিত হচ্ছে।
- শব্দ: শব্দ তরঙ্গকে বিচ্কলীত অংশে নমুনা নেওয়া হয় এবং সেগুলোকে বাইনারি কোডে রূপান্তর করে ফেলা হয়। এটাই কম্পিউটারকে গান বা যেকোনো শব্দ ধারণ এবং পুনঃউৎপাদন করতে দেয়।
সরলতার শক্তি
- ভরসা: শুধু দুটো অবস্থা (চালু/বন্ধ) থাকার ফলে কম্পিউটারের ভুল করার সম্ভাবনা অনেক কমে যায় যেখানে অনেক বেশি অপশন থাকতো।
- দক্ষতা: ইলেক্ট্রনিক সুইচগুো অবিশ্বাস্য রকম সহজে এবং দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যা কম্পিউটারকে হিসাব-নিকাশে মুহূর্তের মধ্যে করে ফেলার ক্ষমতা দেয়।
কম্পিউটারে বাইনারি কোড কীভাবে কাজ করে?
- যখন আপনি এক সারি 0 আর 1-কে বাইনারি কোড হিসেবে চিহ্নিত দেখেন, বাস্তবে তখন আপনি একটা বিশেেষ ধরনের কোড দেখছেন। এই কোড শূন্য আর এক দিয়ে তৈরি হয়, সেটাই এই পদ্ধতির মূল সূত্র।
- বাইনারি কোডে থাকা শূন্য আর একগুলো মিলে একটি স্ট্রিং বা সারি বানায়। কম্পিউটার যখন কোনো ডেটা বা তথ্য কাজে লাগায়, এসব স্ট্রিং প্রসেস করে সেগুলোকে এক বিশেষ ধরনের শক্তিতে পরিণত করে – তড়িৎ শক্তি।
- এই শক্তি জমা থাকেে ট্রানজিস্টর এবং ক্যাপাসিটরের মত বিশেষ যন্ত্রাংশে। এইসব যন্ত্রের উপরই নির্ভর করে একটা কম্পিউটার তথ্য জমা করা বা প্রসেস করতে পারে কিনা। যখন আপনি তার দিয়ে বা ওয়্যারলেস সিগন্যাল দিয়ে তথ্য পাঠান, বাস্তবে পাঠাচ্ছেন ‘বিট’।
- ‘বিট‘ তথ্যের একেবারে ছোট-ছোট অংশ যা কম্পিউটারকে জানায় কি ধরনের তথ্য আপনি সঞ্চয় করতে চান। বিটগুলো আসার পরে তা বাইনারি কোডে রূপান্তরিত করা হয়।
- প্রসেস হয়ে কোডে পরিণত হয়ে গেলেই কম্পিউটার সেই বিটগুলো প্রসেস করে তড়িৎ শক্তিতে পরিবর্তন করতে পারে এবং এই ব্যাপারটিই আসলে কম্পিউটারকে কোনো কাজ করার নির্দেশ দেয়।
- হতে পারে কম্পিউটার “হ্যালো ওয়ার্ল্ড!” বাক্যটি জমা করার নির্দেশ পেল। খুব সাধারণ মনে হলেও, নির্দেশটি কার্যকর করতে কম্পিউটারকে আগে সেই কথাগুলোকে তড়িৎ শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তার আগে তাকে তথ্যগুলোকে বাইনারি কোডে নিতে হবে। বাইনারি কোড হয়ে গেলেই কম্পিউটার সেই তথ্য তার মেমরিতে জমা রাখতে পারবে।
- যেকোনো ধরনের তথ্যই কম্পিউটার মেমরিতে রাখতে পারে। টেক্সট ডকুমেন্ট, ছবি, ভিডিওসহ আরও কত কী! একটা ফাইল কম্পিউটার বা ল্যাপটপে সেভ করতে গেলে সেটি আসলে বাইনারি কোড হিসেবে সেভ হয়, যেন কম্পিউটার সেই ডেটা প্রসেস করতে পারে।
- একই ব্যাপার ঘটে যখন ইন্টারনেট থেকে কোনো ফাইল কাজে লাগান। ব্রাউজারে কোনো লিংকে ক্লিক করে ওয়েবসাইট ওপেন হয়, তখন ডেটা আপনার কম্পিউটারে বাইনারি কোড হিসেবেই পৌঁছায়। এই প্রক্রিয়াকরণ শেষ করেই কম্পিউটার সেই তথ্যটি আপনার সামনে তুলে ধরে।
এক বাইনারি জগত
সামপ্রতিক এক হিসাবে ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীতে প্রায় ৬০ জেটাবাইট তথ্য গচ্ছিত আছে (এটা এমন এক নাম্বার যার শেষে ৬ এর পরে ২১টি শূন্য আছে!) এইসব অবিশ্বাস্য পরিমাণ তথ্য মূলত হচ্ছে শুধু শূন্য আর একের বিভিন্ন সমন্বয়! [সূত্র: Statista]
পরের বার যখন কম্পিউটার ব্যবহার করবেন, তখন মনে রাখবেন – শূন্য আর একের এক অন্তহীন সিম্ফোনি আপনার ডিজিটাল জগতটাকে শক্তি জুগাচ্ছে। এবং এর শেষ নেয় দিনের পর দিনের এর চাহিদা এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার বেড়েই চলেছে। ধন্যবাদ!